একাত্তরের এই দিনেঃ ২০ মার্চ: মোহাম্মদ হাসান
উত্তাল ২০ মার্চ ১৯৭১ঃ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অসহযোগ চলছে। স্বাধীনতার জন্য মুক্তি পাগল বাঙালি শুধু ঢাকায় নয় সারাদেশে সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য চুড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে ফেলেছে।
২০ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চতুর্থ দফা বৈঠক ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানিদের টালবাহানায় দিনের পর দিন আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় জনতার ক্ষোভ বাড়তে থাকে। পাকিস্তানিরা শান্তিপূর্ণভাবে বাঙালিদের ক্ষমতা বুঝিয়ে দেবে না একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভেতরে ভেতরে শুরু হয় চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি।
একাত্তরের ২০ মার্চ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং ডক্টর কামাল হোসেনকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বাইরে বিপুল সংখ্যক জনতা অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে থাকে। প্রায় সোয়া দু ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠক ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। এভাবে দিনের পর দিন আলোচনায় ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি।
এছাড়াও আজ জয়দেবপুরের রাজবাড়ীতে অবস্থিত ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন তাদের হাতিয়ার ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়। গ্রামের পর গ্রাম থেকে মানুষ এসে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সবাই মিলে টঙ্গী-জয়দেবপুর মোড়ে ব্যারিকেড গড়ে তোলে নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য শামসুল হকের নেতৃত্বে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর তথ্যমতে,আজ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রাক্তন নৌসেনাদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে তাঁরা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত মুক্তি সংগ্রামের প্রাত সংহতি প্রকাশ করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করার জন্য একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী কমান্ড গঠনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
সকালে কঠোর সামরিক প্রহরা পরিবেষ্টিত রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চতুর্থ দফা আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর ছয়জন শীর্ষ স্থানীয় সহকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
প্রায় সোয়া দুই ঘন্টা আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এসে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তিনি এর বেশী কিছু বলাতে অপারগতা জানিয়ে বলেন, সময় এলে অবশ্যই আমি সব কিছু বলব।
মুক্তিপাগল মানুষের দৃপ্ত পদচারণা আজ রাজধানী টালমাটাল হয়ে ওঠে। মিছিলের পর মিছিল এগিয়ে চলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে শপথ গ্রহণের শেষে একের পর এক শোভাযাত্রা বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনে গিয়ে সমবেত হয়। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশেএকাধিক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে দৃঢ়তার সাথে বলেন, মুক্তি পাগল সাড়ে সাতকোটি বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোন শক্তিই রুখতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।
কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মওলানা মফতি মাহমুদ পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হন।
রাতে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে একটি অনুপ্রেরণাদায়ী দৃষ্টান্ত।
সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম কৌসুলী এ.কে.ব্রোহি সকালে করাচী থেকে ঢাকায় আসেন।
পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টো করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তিনি লন্ডন পরিকল্পনা যা ১৯৬৯ সালে লন্ডনে বসে শেখ মুজিব, খান আবদুল ওয়ালী খান ও মিয়া মমতাজ মোহম্মদ খান দৌলতানা কর্তৃক প্রণীত তা মানবেন না। তিনি বলেন ঐ পরিকল্পনা আওয়ামী লীগ প্রধান কর্তৃক ঘোষিত ৬-দফার ভিত্তিতেই করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
লেখকঃ মোহাম্মদ হাসান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।