প্রাণের ৭১

ড. কামালের পোস্ট মর্টেম ;.ড. কামাল কি পালাবার পথ খুঁজছেন?

-স্বদেশ রায়

১৯৭৮ সালের ৩ জুন ছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সমর্থিত গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের (গজ) রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী জেনারেল ওসমানীর ঢাকার শেষ নির্বাচনী জনসভা। জনসভায় নেতারা প্রায় সবাই এসে গেছেন। তবুও দেখা নেই ড. কামাল হোসেনের। নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগ নেতা (সাবেক রাষ্ট্রপতি) জিল্লুর রহমান বেশ উদ্বেগের সঙ্গে চারপাশে তাকিয়ে বললেন, ড. কামাল সাহেব কই? বঙ্গবন্ধু আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান তাঁর স্বভাব সুলভ ভাষায় জিল্লুর রহমানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ‘চিড়িয়া ভাগ গিয়া’। ড. কামালের সারা জীবনের রাজনীতির দিকে যদি তাকানো হয়, দেখা যাবে সবখান থেকেই তিনি শেষ মুহূর্তে সরে পড়েছেন। তাঁর অতীতের ইতিহাস নিয়ে বহুবার লিখেছি। তাই নতুন করে আর অতীত ইতিহাস টানার দরকার নেই। তবে এবার কামাল-তারেক যে ঐক্য হয়েছে এই ঐক্য থেকেও কি খুব শীঘ্র পালাবার পথ খুঁজছেন ড. কামাল? কারণ, জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত দৈনিক প্রথম আলোর ২৩.১০.১৮ তে প্রথম পাতায় সংবাদ শিরোনাম, ‘ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী জোট নয়- সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল।’ অর্থাৎ এতদিন হৈ চৈ করে আগামী নির্বাচনে লড়ার জন্য ড. কামালের নেতৃত্বে যে ফ্রন্ট গঠিত হলো, সেটা কোথায় গেল? বিএনপির অনেক নেতা তাদের নানান ব্যক্তিগত আলোচনায় সন্তোষ প্রকাশ করলেন; বললেন, ম্যাডাম নেই, তারেক সাহেব নেই এ সময়ে আমরা বর্ষীয়ান নেতা ড. কামালকে আমাদের নেতা বানিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করেছি। অন্যদিকে প্রথম আলোর মতো জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত সংবাদপত্রগুলো এ নিয়ে হাজার রকম কলাম ও সংবাদ পরিবেশন করে একেবারে খৈ ফুটালো- আর সেই সংবাদপত্রকে কিনা ছাপতে হলো, ‘ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী জোট নয়’। নির্বাচনী জোট যদি না হয় তাহলে বিএনপির এত উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া কেন?

বাস্তবে একজন সাংবাদিক হিসেবে যতটুকু খোঁজ খবর পাই তাতে বলতে পারি, বিএনপির অনেক বড় নেতার এই জোট নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস দেখিনি। হ্যাঁ, মধ্যম সারির নেতাদের মধ্যে এবং এক শ্রেণীর জামায়াত-শিবির কর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখেছি। তাদের অবস্থা হয়েছে খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা আর কি! কারণ, জামায়াতের নিজেদের কোন নেতা নেই। অন্যদিকে তারেক ও খালেদা দুর্নীতির মামলায় সাজা পেয়ে রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন। অর্থাৎ বিএনপিও নেতৃত্বশূন্য। এ অবস্থায় তারা খড়কুটো হিসেবে ড. কামালকে আঁকড়ে ধরে একটা বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল। এদের কারও কারও মুখে শুনেছি, মওদুদ সাহেব নাকি ফোনে তারেক রহমানকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন ড. কামালকে। আর তারেক রহমান বলেছেন, আপনি আমার বাবার মতো। এতেই এই সমস্ত মধ্যম সারির ও সাধারণ বিএনপির নেতা-কর্মীরা ধরে নিয়েছে, ড. কামাল এখন থেকে তারেক রহমানের বাপের দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের নিশ্চয়ই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্পের সেই বিখ্যাত লাইন জানা নেই, ‘রানীঘাটে কে কার বাপ!’

তবে ড. কামাল শুধুই কি পালিয়ে যাবার জন্য এ কাজে নেমেছিলেন? মোটেই তা হতে পারে না। তিনি একটা হিসাব করে নেমেছিলেন। যেমন ১/১১ এর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ড. ইউনূস একটা হিসাব করে নেমেছিলেন। আবার যখনই হিসাবে গরমিল দেখেন অমনি টিপিকাল মধ্যবিত্ত চরিত্র প্রকাশ পায়, কোন জবাবদিহিতা ছাড়াই পালিয়ে যায়। এর সব থেকে বড় কারণ হচ্ছে, এই টিপিকাল মধ্যবিত্ত চরিত্রের মানুষগুলোর সব সময়ই রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া, প্রধানমন্ত্রী হওয়া- এসব বিষয়ে খুব খায়েশ থাকে। তবে তারা বুঝতে পারে না একজন আইনজীবী হিসেবে বা ব্যাংকার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়া আর রাজনীতিক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়া সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর বিষয়। একটা ক্যারিয়ার হচ্ছে নিজে কিছু পাবার জন্য, অন্যটি হচ্ছে নিজেকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দেবার জন্য। টিপিকাল আত্মকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত চরিত্র কখনই নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্য হয় না। যেমন দরিদ্রের ব্যাংক করে ড. ইউনূস এমন ধনী হয়েছেন যে, তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীকেও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। অর্থাৎ সৌদি বাদশা আর কি! অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ কারোরই মৃত্যুর পরে কোন ব্যাংক ব্যালান্স পাওয়া যায়নি। এমনকি ব্যাংক ব্যালান্স মেলেনি গাজী গোলাম মোস্তফারও। আবার ১/১১ এর পরে কালোটাকা সাদা করতে হয়েছিল ড. কামাল হোসেনকে। অবশ্য ড. কামাল বলতে পারেন, সেদিন তো খালেদা জিয়া, সাইফুর রহমান সবাইকে কালো টাকা সাদা করতে হয়েছিল। এখানেই মেলে ড. কামালকে নিয়ে অনেক হিসাব নিকাশের উত্তর। অর্থাৎ শেখ হাসিনার কোন কালো টাকা ছিল না বলে শেখ হাসিনার কাছ থেকে ড. কামাল চলে গিয়েছিলেন। আর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি প্রমাণ করে দিলেন, বাস্তবে তিনি খালেদার পৃথিবীর লোক। কালো টাকার লোক। তিনি কখনই শেখ হাসিনার স্বচ্ছ পৃথিবীর লোক নন।

তবে তারপরেও কেন ড. কামালের এই পালিয়ে যাবার ইঙ্গিত। কেন তিনি হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন ডেকে বললেন, তার জোট নির্বাচনী জোট নয়। ড. কামালকে কেউ কম বুদ্ধিমান মনে করলে তিনিই বোকা হবেন। বরং এখানে শুধু বলা যায়, ড. কামাল মনে করেছিলেন তিনি জোট গঠনের পরে সারাদেশে এমন সাড়া পড়বে এবং শেখ হাসিনা এতটা ভীতু হয়ে যাবেন যে, তিনি আইন আদালতকে উল্টে-পাল্টে ফেলতে পারবেন। তাছাড়া তিনি টকশো শুনে, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার পড়ে জামায়াত ও বিএনপিকে একটু বেশি শক্তিশালী মনে করেছিলেন। এই কাচের ঘরে বাস করা মধ্যবিত্ত চরিত্রের মানুষগুলো মনে করেন রাজনীতির ঘরটিও মনে হয় কাঁচ দিয়ে ঘেরা থাকে। সেখানে একটা পাথর ছুড়লেই ভেঙ্গে যাবে। এই পাথর ছুড়তে গিয়ে এবার ড. কামাল গং এবং প্রথম আলো গং বারবার দাবার ঘুঁটি ধরছেন দুর্নীতিবাজদের ওপরে। যেমন তারা প্রথম দাবার ঘুঁটি ধরেছিলেন সিনহার মতো একজন দুর্নীতিবাজ বিচারপতির ওপর। তারা মনে করেছিলেন, ওই দুর্নীতিবাজ বিচারপতিকে দিয়ে তারা জুডিসিয়াল ক্যু করাবে বাংলাদেশে। তারা বুঝতে পারেনি বাংলাদেশের অন্য বিচারপতিরা সৎ এবং দেশপ্রেমিক, তারা কেউই সিনহার মতো অসৎ, দুর্নীতিবাজ ও দেশদ্রোহী নয়। যাহোক, তাদের সিনহা চ্যাপটার কাঁচের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে। এর পরে এই গং এসে ভর করে জামায়াত-বিএনপির ওপর। মনে করেছিল এই সরকারের দশ বছর হয়ে গেছে, এর ফলে জামায়াত-বিএনপি এখন জনসমর্থনে টইটুম্বুর। ড. কামাল এলেই খালেদার দুর্নীতি ঢেকে গিয়ে একেবারে নতুন সূর্য উঠবে। বাস্তবে তা হলো না। বরং হলো উল্টো। খালেদার আরেক দুর্নীতির মামলার রায়ের দিন ঠিক হলো ২৯ অক্টোবর।

ড. কামাল গং মনে করেছিলেন তাদের হৈ চৈ এর কারণে আদালত তার সঠিক গতিতে চলতে পারবে না। তাদের সে ধারণা ভুল প্রমাণ করে আগামী ২৯ অক্টোবর খালেদার অপর দুর্নীতি মামলার (জিয়া চ্যারিট্যাবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা) রায় দিতে যাচ্ছে আদালত। ২৯ অক্টোবরের এ রায়টি বাংলাদেশে আইনের শাসন ও সুস্থ রাজনীতির জন্য সর্বোপরি দেশের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর জিয়া অরফানেজ মামলার রায়ের পরে যেমন বাংলাদেশের রাজনীতিতে, আইনের শাসনে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে, ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিট্যাবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের পরেও ঠিক তেমনই আরেকটা বড় পরিবর্তন আসবে। আর এটা অন্য বিএনপি নেতা বা প্রথম আলো গং না বুঝলেও ড. কামাল বুঝতে পেরেছেন। ড. কামাল সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল বলতেন, ড. কামাল হচ্ছে জাহাজের ইঁদুর। জাহাজের তলা ফেঁসে গেলে সেই আগে টের পায়। এবং সবার আগে জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে। ড. কামালের সঙ্গীরা না বুঝলেও তিনি বুঝে গেছেন এমনিতে তার ঐক্যের জাহাজের তলায় ফাটল আর ২৯ অক্টোবরের মামলার রায়ের পরে এ জাহাজের তলা একেবারেই ঝরে পড়বে। এটা বুঝতে পেরেই ড. কামাল তার জোট সঙ্গীদের বাদ দিয়ে শুধু তার নিজস্ব দোকান গণফোরামের মাধ্যমে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিলেন, তার পালানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর ড. কামাল, ড. ইউনূস এরা যখন পালায় তখন এদেরকে বাপ ডেকেও কোন লাভ হয় না। তাই তারেক হোক আর প্রথম আলো হোক যেই এখন ড. কামালকে বাপ ডাকুক না কেন তাতে কোন লাভ নেই। মহানগর নাট্যমঞ্চ থেকে যে নাটকের অঙ্ক শুরু হয়েছে তার থেকে লাফ দিয়ে পালানোর অঙ্ক দেখার জন্য আর বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*