প্রাণের ৭১

সরকার-কট্টরপন্থী চুক্তির পর স্বাভাবিক হচ্ছে পরিস্থিতি

প্রাণ বাঁচাতে পাকিস্তান ছাড়লেন আসিয়ার আইনজীবী

ধর্ম অবমাননা নিরোধ আইনের মামলা থেকে খ্রিস্টান নারী আসিয়া বিবিকে বাঁচানোর পরই পাকিস্তান ছাড়তে বাধ্য হলেন তাঁর আইনজীবী সাইফ-উল-মুলক। কট্টরপন্থীদের হুমকির মুখে নিজের প্রাণ বাঁচাতে গতকাল শনিবার তিনি ইউরোপের উদ্দেশে পাকিস্তান ছাড়েন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আসিয়া বিবি খালাস পাওয়ার পর থেকেই কট্টরপন্থীরা ওই রায়ের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু করে। সাইফ-উল-মুলক বলেছেন, এমন পরিস্থিতিতে দেশে থাকা তাঁর জন্য নিরাপদ নয়।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকারও প্রথম দিকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কট্টরপন্থীদের প্রতি কঠোর অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের মুখে নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছে। সরকার কট্টরপন্থী মুসলিম দল তেহরিক-ই-লাবাইকের (টিএলপি) সঙ্গে চুক্তি করেছে। ওই চুক্তির পর টিএলপি বিক্ষোভ বন্ধ করেছে। তারা আটকে রাখা সড়কগুলো ছেড়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। দেশটির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া খ্রিস্টান নারী আসিয়া বিবিকে গত বুধবার খালাস দেওয়ার রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। এ ঘটনার পর থেকেই পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ শুরু করে জনজীবন অচল করে দেয় কট্টরপন্থী ধর্মীয় সংগঠনগুলো। তারা নিশানা করে আইনজীবী সাইফ-উল-মুলককেও। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে গতকাল সকালে দেশ ছাড়েন সাইফ-উল-মুলক। যাওয়ার আগে তিনি তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে আবেদনও জানান।

ইউরোপের উদ্দেশে বিমানে ওঠার আগে ৬২ বছর বয়সী আইনজীবী সাইফ-উল-মুলক বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার পাকিস্তান থাকা সম্ভব নয়। আসিয়া বিবির জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্যই আমার বেঁচে থাকার দরকার রয়েছে।’

এদিকে সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কট্টরপন্থী মুসলিম দল টিএলপির সঙ্গে এক চুক্তিতে এসেছে। চুক্তির পর টিএলপি আন্দোলন প্রত্যাহার করেছে। দলটি রায় ঘোষণাকারী বিচারকদেরও হুমকি দিয়েছিল।

চুক্তিতে বলা হয়েছে, সরকার আসিয়ার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেবে। সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করারও সুযোগ দেওয়া হবে। রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ থেকে যাদের আটক করা হয়েছে, সরকার তাদের ছেড়ে দিলেও যারা সহিংসতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলবে। এর বদলে টিএলপি বিক্ষোভ বন্ধ করবে এবং সমর্থকদের রাস্তা থেকে সরিয়ে নেবে। মুক্তি পাওয়ার পর আসিয়া তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেন—এমন ইঙ্গিতের মধ্যেই টিএলপি ও সরকারের মধ্যে চুক্তিটি হয়।

পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী চুক্তির বিষয়ে বলেন, এখনই উগ্রবাদ দমন না করতে পারায় এ পথেই হাঁটতে হচ্ছে তাঁদের। তিনি বলেন, ‘দুটি পথ আছে। শক্তি প্রয়োগ করা কিংবা মধ্যস্থতা। শক্তি প্রয়োগে প্রাণহানি হবে, একটি রাষ্ট্র এমনটা করতে পারে না। আর মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে কিছু পেতে হলে কিছু ছাড় দিতেই হবে।’ এর মাধ্যমে সরকার উগ্রবাদীদের দাবির মুখে মাথানত করছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

‘উগ্রবাদের বিরুদ্ধে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ধরনের সহিংস বিক্ষোভের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নিতে হবে এবং স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে হবে। এ মুহূর্তে এটা নিরাময় করা যাচ্ছে না। এখন আমরা যা করছি, তা হলো আগুনে পানি ঢালা। কিন্তু নিরাময় করতেই হবে, আর সেটা করতে আমাদের সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’, বলেন এ পাকিস্তানি মন্ত্রী।

এই চুক্তিকে মৌলবাদীদের কাছে সরকারের ‘ফের আত্মসমর্পণ’-এর ঘটনা উল্লেখ করে পাকিস্তানের দৈনিক পত্রিকা ডন মন্তব্য করে, কট্টরপন্থীদের সব কটি দাবিই মেনে নিয়েছে ইমরান খান নেতৃত্বাধীন সরকার। যদিও মৌলবাদীদের সঙ্গে সরকারের এই বোঝাপড়ায় হতাশ দেশের উদারমনস্ক মানুষ।

আসিয়া বিবির মামলাটি পাকিস্তানের অন্যতম হাই প্রফাইল মামলা। তাঁর মুক্তির দাবিতে সরব হয়েছে সারা দুনিয়ার একাধিক মানবতাবাদী সংগঠন। পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট ও পোপ ফ্রান্সিস, পর পর দুই খ্রিস্টান ধর্মগুরু তাঁর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। আসিয়ার মুক্তির দাবিতে সমর্থন জানানোর জন্য আততায়ীদের হাতে খুন হন পাকিস্তানের সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টি এবং পঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির। এই জোড়া খুন সারা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছিল—পাকিস্তানে মৌলবাদীদের হাত কতটা দূর যেতে পারে। সূত্র : এএফপি, বিবিসি।



« (পূর্বের সংবাদ)



মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*