প্রাণের ৭১

প্রার্থি বাছাইয়ে আওয়ামী মহাজোটে’র কেন আরও সতর্কতা প্রয়োজন

আবদুল গাফ্‌ফারর চৌধুরীঃঃ- কী লিখব, কী করে লিখব, তা-ই আজ ভাবছি। দেহ-মন দুই-ই অবসন্ন। পরপর দুটি মৃত্যুসংবাদ আমার চিন্তা-চেতনা দুই-ই অবশ করে ফেলেছে। তবু লিখতে হবে। সম্পাদকের অর্ডিন্যান্স—দেশের রাজনীতির এই উত্তাল মুহূর্তে লেখা বন্ধ করা চলবে না। এবং লিখতে হবে দেশের রাজনীতি নিয়েই। অগত্যা মধুসূদন! কলম ধরেছি। যে দুজনের মৃত্যু আমার চিন্তা-চেতনাকে অবশ করে ফেলেছে, তারা দুজনই আমার তরুণ বন্ধু। দুজনই খ্যাতিমান তরুণ কবি। দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু থাকতেন বার্মিংহামে। আর মুনীরা চৌধুরী ছিলেন ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফে। এই তরুণী কার্ডিফে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে কয়েকবার কার্ডিফে গেছি। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন শুক্রবারও তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হয়েছে।

দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু অসাধারণ শক্তিশালী কবি ছিলেন। তাঁর একটি কবিতাগ্রন্থ ‘বিদ্যুতের বাগান সমগ্র’ এখনো আমার লেখার টেবিলে সামনেই রয়েছে। মাত্র কয়েক মাস আগে তাঁর ক্যান্সার হওয়ার খবর পাই। এত শিগিগরই (গত শনিবার) তিনি চলে যাবেন ভাবতে পারিনি। মুনীরার সঙ্গে গত শনিবারও আমার কথা হয়েছে। প্রবাসে থেকেও তাঁর কবিতা যেন বাংলা কবিতার নতুন ধারাকে একটা নতুন গতি দিচ্ছিল। তাঁর কবিতার বইও আমার টেবিলে। শনিবার (১৭ নভেম্বর) বিকেলে তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো। পরদিন, রবিবার দুপুরেই জানতে পারলাম, মুনীরা নেই। তিনি আত্মহত্যা করেছেন। খবরটা শুনে আমার বুক ভেঙে গেছে। টেলিফোনটার দিকে চেয়ে ভেবেছি, এই টেলিফোনে আর তাঁর কণ্ঠ শুনব না। প্রিয় পাঠক, মানুষ তার সুখের ভাগ সবাইকেই দিতে পারে, শোকের ভাগ কাউতে দিতে পারে না। ব্যক্তিগত শোকের কথা থাক। এখন দেশের কথা বলি।

এক.

৩০ ডিসেম্বর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এটা এখন নিশ্চিত মনে হয়। দুটি বড় জোটই তাদের প্রার্থী বাছাই শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, জোটের শরিকদের ৬৫ থেকে ৭০ আসন ছাড়বে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপি রবিবার সকালে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের মনোনয়ন প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ দ্বারা তাদের বাছাইকার্য শুরু করেছে। শরিক দলগুলোকে তারাও অনেক আসন ছেড়ে দেবে। প্রার্থী বাছাই কনফারেন্সে তারেক রহমান স্কাইপে হাজির ছিলেন। তা নিয়ে আপত্তি উঠেছে আওয়ামী জোটের পক্ষ থেকে। ওবায়দুল কাদের এ রকম একজন দণ্ডিত ও পলাতক ব্যক্তি ভিডিও কনফারেন্স করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন কি না সেই প্রশ্ন রেখেছেন ইলেকশন কমিশনের কাছে।

নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না আমি জানি না, আমি আগেই লিখেছিলাম, ঐক্যফ্রন্ট একটি খোলস মাত্র। আসল জোট বিএনপি-জামায়াতের। এবং তার অবিসংবাদিত নেতা তারেক রহমান। প্রার্থী বাছাইয়ে এবং নির্বাচন পরিচালনায় দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি হবেন সর্বেসর্বা। নির্বাচন কমিশন যদি তাঁর ভিডিও কনফারেন্সে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলেও তিনি অন্য মাধ্যমে, প্রকাশ্যে না এসে ফ্রন্টকে পরিচালনা করবেন।

দুই.

নির্বাচনে রাজনৈতিক পোলারাইজেশনটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। এটা মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের লড়াই। আওয়ামী লীগ খারাপ হোক আর ভালো হোক, দেশের অসাম্প্রদায়িক ও বাম গণতান্ত্রিক দলগুলো অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচরিত্র রক্ষার স্বার্থে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোটবদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে স্বাধীনতার মূল আদর্শের বিরোধী বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে জোটবদ্ধ হয়েছে তাদের সমমনা দলগুলো। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের নামে যারা বিএনপি জোটে নতুন ঢুকেছে, তারা নিজেদের আলাদা অস্তিত্বের কথা যতই বলুক, বিএনপির ধানের শীষ হাতে যাঁরা নির্বাচনে নামবেন, তাঁরা ভোটারদের কাছে বিএনপির প্রার্থী হিসেবেই পরিচিত হবেন। নির্বাচিত হলে বিএনপি এবং তারেক রহমানের নির্দেশ মেনেই চলতে হবে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মহাজোট থেকে যারা নির্বাচন করবে, তাদের প্রায় সব শরিক দলই (সম্ভবত একমাত্র এরশাদ সাহেবের জাতীয় পার্টি ছাড়া) আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে নামবে। এমনকি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারাও আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক চেয়েছে বলে জানা গেছে। তা যদি হয়, এবারের নির্বাচনযুদ্ধটা হবে মূলত নৌকা ও ধানের শীষের মধ্যে। দেশের রাজনৈতিক পোলারাইজেশনটাও সেভাবে হয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ আওয়ামী লীগ-মহাজোটে থাকার ঘোষণা দিয়েও তাঁর দলের প্রার্থীরা তাঁদের লাঙল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে নামার কথা বলছেন বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাবে, এরশাদ সাহেবসহ কয়েকজন লাঙল প্রতীক ব্যবহার করছেন। কিন্তু তাঁদের অন্যান্য প্রার্থী নৌকা প্রতীক ব্যবহারেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন বলে জানা যায়।

সম্প্রতি এরশাদ সাহেব বলেছেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের কাছে ১০০ আসনের তালিকা দিয়েছি। তার মধ্যে ৭০ আসন তো পেতে পারি।’ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শরিকদের ৬৫ থেকে ৭০ আসনের বেশি দেওয়া যাবে না। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টিকে একাই যদি ৭০ আসন দেওয়া হয়, তাহলে অন্যান্য শরিক দল কী পাবে? এরশাদ সাহেব এই আসন বণ্টন নিয়ে ঘোঁট না পাকালে ভালো কথা। কিন্তু তিনি ঘোঁট পাকাতে পারেন। রুটিন চেকআপের নাম করে তাঁর সিএমএইচে ভর্তি হওয়াটা আমার কাছে খুব সুলক্ষণ মনে হয়নি।

শরিক দলগুলোর কোনোটার সঙ্গে যদি মহাজোটকে কোনো দরকষাকষিতে পড়তে হয়, সেটি হবে এরশাদ সাহেবের দলের সঙ্গে। তিনি অতীতেও নির্বাচনের সময় নানা রকম খেল দেখিয়েছেন। এবারও হয়তো দেখাতে চাইবেন। তবে এবার আওয়ামী লীগ জোটের রাজনৈতিক অবস্থান অনেক শক্ত। এরশাদ সাহেব পরিস্থিতি ভালো বোঝেন। ঢাকার এক সাংবাদিক বন্ধু এ সম্পর্কে আমাকে একটা ধাঁধা বলে তাঁর উত্তর চেয়েছেন।

তিনি বলেছেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ এবং সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর রাজনৈতিক ‘কেবলা’ একটাই। সেখানেই তাঁরা মাঝে মাঝে যান। তাহলে এরশাদ সাহেব রইলেন আওয়ামী মহাজোটে আর কাদের সিদ্দিকী গেছেন ঐক্যফ্রন্টে—এর রহস্যটা কী? বলেছি, এরশাদ সাহেবকে যতটা বুদ্ধিমান ভাবা হয়, তিনি তার চেয়েও বেশি বুদ্ধি রাখেন। নইলে স্বৈরাচারী হিসেবে পতনের পর তিনি বাঁচতে পারতেন না। কিন্তু কাদের সিদ্দিকী নিজেকে যতটা বুদ্ধিমান মনে করেন, ততটা বুদ্ধিমান নন। বুদ্ধিমান হলে শুকনো ধানের শীষ থেকে ফসল আশা করতেন না।

জামায়াতকে নিয়ে ঐক্যফ্রন্টে কোন্দল দেখা দিতে পারে। ড. কামাল হোসেন বলেছেন, তাঁরা বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন করেছেন, জামায়াতের সঙ্গে নয়। এটা শরত্চন্দ্রের টগর বোষ্টমীর মতো কথা—‘মিনেসর সঙ্গে ২০ বছর ঘর করছি বটে, কিন্তু মিনেসকে কোনোদিন হেঁসেলে ঢুকতে দেইনি।’ ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতার সম্ভবত ধারণা, ‘তাঁরা বিএনপির সঙ্গে ঘর করছেন বটে, জামায়াতকে হেঁসেলে ঢুকতে দেবেন না।’ কিন্তু বিএনপি ও জামায়াত যে দেহ-মনে এক এবং জামায়াত ঐক্যফ্রন্টের হেঁসেলে ঢুকে বসে আছে, সেটা হয়তো খ্যাতনামা আইনজ্ঞ তাঁর আইনি কৌশলে ঢেকে রাখতে চান।

এরই মধ্যে বিএনপির প্রার্থী বাছাইয়ের সভার আলোচনার যে ছিটেফোঁটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে, তাতে জানা যায়, জামায়াতের দাবি মোতাবেক বিএনপি তাদের এক বিশালসংখ্যক প্রার্থীকে ধানের শীষ প্রতীক দেবে। তা ছাড়া জামায়াত সুযোগ খুঁজছে, তারা যাতে অন্য কোনো কোনো ইসলামী দলের প্রতীকেও প্রার্থী দাঁড় করাতে পারে এবং সম্ভব হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও তাদের আরো অনেক প্রার্থীকে মঞ্চে নামাতে পারে।

অনেকের সন্দেহ, আওয়ামী লীগেও তারা অনুপ্রবেশ করে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে আওয়ামী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হওয়ার আশা করছে। একসময় বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে দলটিকে তারা গ্রাস করেছে। তাদের সেই গ্রাস থেকে বিএনপি এখনো মুক্ত হতে পারেনি। এখন তাদের লক্ষ্য, সন্ত্রাস দ্বারা আওয়ামী লীগকে যখন ধ্বংস করা যায়নি, তখন দলটিকে গ্রাস করা দরকার। দীর্ঘদিন ধরেই মিডিয়ায় খবর বের হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে দলে দলে জামায়াতকর্মী ও নেতা আওয়ামী লীগে ঢুকছে। আগামী নির্বাচনের আগে তারা এ ব্যাপারে আরো ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাবে।

জামায়াতের এই ভূমিকা আওয়ামী লীগের মহাজোট ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট—দুই জোটের জন্যই বিপজ্জনক। জামায়াতের প্রতি অধিক দাক্ষিণ্য দেখাতে গেলে ঐক্যফ্রন্টের ঐক্যে চিড় ধরতে পারে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শিবিরের আ স ম রব প্রমুখ তাঁদের শত্রুশিবিরে যোগ দিয়ে তাদের প্রতীক হাতে তাদের হয়ে যুদ্ধে নেমেছেন। এটা ঐক্যফ্রন্টের নৈতিক শক্তি নষ্ট করবে, চাই কি নির্বাচনের আগে ফ্রন্টের ঐক্যে ভাঙন ধরাতেও পারে।

আওয়ামী লীগে জামায়াতের অনুপ্রবেশের চেষ্টা সফল হলে তা হবে মহাজোটের জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া। অবশ্য শেখ হাসিনা এ সম্পর্কে বহু আগে সতর্ক হয়েছেন এবং পদক্ষেপ নিয়েছেন। তথাপি আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজে আওয়ামী লীগকে আরো বেশি সতর্ক ও কঠোর হতে হবে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মতো জামায়াতিরা যাতে ছদ্ম আওয়ামী লীগার সেজে সংসদ নির্বাচনে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাইটা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। পুরনো সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাঁরা জামায়াতঘেঁষা বলে পরিচিত হয়েছেন, তাঁদের যেমন বাদ দিতে হবে, তেমনি নতুন প্রার্থীদেরও অতীত ও বর্তমান ভালোভাবে যাচাই করতে হবে।

আসলেই ৩০ ডিসেম্বর দেশের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষার দিন। এই পরীক্ষায় আওয়ামী লীগকে জয়ী হতেই হবে।



« (পূর্বের সংবাদ)



মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*