সংশ্লিষ্টরা জানান, সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অভিযানের পরেও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় তেমন প্রভাব পড়েনি। অভিযানকালে অনেক মালিক ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়কে নামান না। তবে অভিযান শেষে আবারও সড়কে চলে এসব যানবাহন। এছাড়া বরাবরের মতো সড়কে বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোর কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ নভেম্বর সকালে পটিয়া উপজেলার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের শাহ মার্কেট এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন জান্নাতুল মাওয়া ইসা (১২)। সে স্থানীয় বিনিনিহারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। এছাড়া একই বছরের ২০ নভেম্বর দুপুরে সাতকানিয়ার ছদাহা কেফায়েত উল্লাহ আহমদ কবীর উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. তাহসিন (১২) ট্রাক চাপায় নিহত হয়। ১৯ নভেম্বর বন্দর থানাধীন পুরাতন পোর্ট মার্কেট সংলগ্ন সড়কে টমটমের ধাক্কায় বেসরকারি সংস্থা ঘাসফুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার্থী (পিইসি) সুমনা আকতার (১১) মারা যায়। এছাড়া ৫ অক্টোবর বোয়ালখালীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন কলেজছাত্র আবির ইসলাম ফাহিম (১৮)। তিনি বোয়ালখালী সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের ব্যবসা শাখার একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। একই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর সিআরবির পলোগ্রাউন্ড এলাকায় বাসের ধাক্কায় আলমগীর হোসেন রিয়াদ (২৫) নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হন। রিয়াদ ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। এছাড়া ১৯ জুন দুপুরে নগরীর জাকির হোসেন সড়কের হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে বাসের ধাক্কায় নিহত হন চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিথি বড়ুয়া (২১)।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মাঝে মাঝে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেগুলো অনেক সময় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান পরিচালনার সময় ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়ক থেকে উধাও হয়ে যায়। অভিযান শেষে আবার সড়কে নামে এসব যানবাহন। এছাড়া অধিকাংশ যানবাহনের চালক প্রশিক্ষিত না। অনেকের আবার লাইসেন্সও নেই। পুলিশকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে সড়কে এসব ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলে-এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জরিপেও এসেছে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হলো যানবাহনের বেপরোয়া গতি। বেপরোয়া গতির পাশাপাশি চালকের অদক্ষতা, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন না মানা, ওভারটেকিং করা, গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জেব্রা ক্রসিং না থাকা ও না মানা, গাড়ি চালানো অবস্থায় চালকের মোবাইল ফোনে কথা বলা, রাস্তার নির্মাণ ত্রুটি, ফুটপাত দখল এবং যাত্রীদের অসতর্কতাও অনেকাংশে দায়ী।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর সাথে সাথে সরকারের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। প্রায় সময় দেখা যায়, চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে ধর্মঘটের ডাক দেয় পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাই জাতীয় স্বার্থে সড়ক দুর্ঘটনা কীভাবে কমিয়ে আনা যায় এই লক্ষ্যে সরকারকে কাজ করতে হবে। এছাড়া কোনোভাবেই যেন হেলপার কিংবা অদক্ষ কাউকে লাইসেন্স না দেওয়া হয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে বর্তমানে যানবাহন আছে ৩৫ লাখ ৪২ হাজার। মোটরযান আইন অনুযায়ী চাকা, ইঞ্জিন ক্ষমতা ও ধরণ বিবেচনায় নিয়ে ৪০ ধরনের যানের নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের ফিটনেস সনদ দরকার হয় না। সারা দেশে মোটরসাইকেল আছে ২২ লাখ ৪০ হাজার। কারসহ অবাণিজ্যিক যানবাহনের ক্ষেত্রে তৈরির সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের ফিটনেস সনদ একসঙ্গে দেওয়া হয়। বাস, ট্রাকসহ যানবাহনের ফিটনেস সনদ নিতে হয় প্রতি বছর।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের (আঞ্চলিক কমিটি) সভাপতি মোহাম্মদ মুছা দৈনিক আজাদীকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মালিকদেরকেও সচেতন হতে হবে। তারা চালকদের দৈনিক চুক্তিতে গাড়ি চালাতে দেন। এতে চালকরা অনেক বেশি যাত্রীর আশায় যে রুটে চলাচলের কথা সে রুটে চালায় না। নগরীতে ১৭টি রুট আছে। এসব রুটে যাত্রী থাকুক আর না থাকুক চালকদের নির্দিষ্ট গন্তব্য পর্যন্ত গাড়ি চালাতে হবে। অনেক সময় চালকরা অর্ধেক পথে বলে, গাড়ি আর যাবে না। এই বিষয়গুলো ট্রাফিক পুলিশকেও খেয়াল করতে হবে। মূলত রাস্তায় যানবাহনের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া গাড়ি কোথায় দাঁড়াবে তা সিটি কর্পোরেশনকে মার্কিং করে দিতে হবে। যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠালে চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ সেই দায়িত্বটি পালন করে না। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি আমাদেরও কাম্য নয়। ড্রাইভারের ওপর দোষ চাপিয়ে, তাকে শাস্তি দিয়ে যদি সমাধান হয়ে যায়, তাহলে আমাদের আপত্তি নেই। আমার মতে, ট্রাফিক ও চালক উভয় পক্ষকে সংশোধন হতে হবে।
তিনি আরো বলেন, এখন চট্টগ্রাম শহরের কোথাও ফুটপাত নাই। ফুটপাতগুলো ভ্রাম্যমাণ হকারদের দখলে চলে গেছে। শুধু তাই নয়, অনেক জায়গায় রাস্তার এক পাশ দখল করে ভ্যানে করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করা হচ্ছে। এতে মোড়ে মোড়ে মানুষের জটলা সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন মোড় যেন একেকটি ভ্রাম্যমাণ বাজার। এখন রাস্তায় যদি ব্যবসা হয়, তাহলে চালক কিভাবে গাড়ি চালাবে? এ বিষয়গুলো ট্রাফিক পুলিশকে দেখতে হবে। এছাড়া অনুমোদনহীন ছোট ছোট প্রচুর গাড়ি রাস্তায় চলছে। এসব গাড়ি শহরকে জঞ্জালময় করে তুলছে। কিন্তু সেইদিকে কারো নজর নাই। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে ড্রাইভারদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে যেন সবাই দায় সারে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলার এয়ারপোর্ট রোডে বাস চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। এই ঘটনার পর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে নামে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বেপরোয়া গাড়ি চালনায় কেউ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারাত্মক আহত বা নিহত হলে চালকের সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানার বিধান রেখে গত ৬ আগস্ট ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় সরকার।
সড়কে এখনো মৃত্যুর মিছিল
কিছুতেই থামছে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের দেশব্যাপী নজিরবিহীন আন্দোলনেও গণপরিবহনে ফেরেনি শৃঙ্খলা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সড়ক নিরাপত্তা আইন ২০১৮ সংসদে পাস হয়েছে, তারপরেও চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতা যেন থামছেই না। সড়ক দুর্ঘটনায় একে একে মৃত্যু হচ্ছে শিক্ষার্থীর। সেই সাথে মৃত্যু হচ্ছে এসব শিক্ষার্থীকে নিয়ে বোনা তাদের মা-বাবার স্বপ্নেরও। সর্বশেষ গতকাল এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী সোমা বড়ুয়া। কোতোয়ালী মোড় এলাকায় রাস্তা পার হতে গিয়ে কাভার্ড ভ্যান চাপায় মৃত্যু হয় তার।
x
« আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে বিএনপি সন্ত্রাসী দল : কাদের (পূর্বের সংবাদ)
(পরবর্তি সংবাদ) সীতাকুণ্ডে দুর্ঘটনায় মোটর সাইকেল আরোহী নিহত »