প্রাণের ৭১

চিকিত্সা সেবার অগ্রগতিতে বাধা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি

আন্তর্জাতিক মানের চিকিত্সক আছেন, চিকিত্সায় সফলতাও দেখাচ্ছেন. প্রয়োজন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ** পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও উন্নত ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে ** মনিটরিং না থাকায় নামিদামি বেসরকারি হাসপাতালেও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও অব্যবস্থাপনা ধরা পড়ছে ** ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর মনিটরের আওতায় আনতে হবে

চিকিত্সা সেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বের অত্যাধুনিক নিউরো সাইন্স হাসপাতাল এন্ড ইনস্টিটিউট ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটেও আন্তর্জাতিক মানের চিকিত্সা সেবা দেওয়া হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের ডাক্তার ও নার্সরা এখানে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। মেডিক্যাল শিক্ষার গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। তবে চিকিত্সা বিজ্ঞানে আরো অগ্রগতি অর্জনের ক্ষেত্রে এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিকিত্সকদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়া। আর এই রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। সরকারি হাসপাতালে স্বাচিপ, বিএমএ’র নামে এক শ্রেণীর চিকিত্সকদের মধ্যে চলছে চরম দলাদলি। আর এই দলাদলির কারণে তদ্বির করে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে চিকিত্সকদের যে দলাদলি চলে, এমনটি পৃথিবীর কোথাও ঘটে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চিকিত্সকরা রাজনীতি করেন চিকিত্সা সেবা আরো এগিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতার নেমে। কিন্তু বাংলাদেশে চলছে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। চিকিত্সা বিজ্ঞানে যোগ্য ও অভিজ্ঞতাকে প্রধান্য দিতে হয়। কিন্তু দলাদলির কারণে বাংলাদেশের সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

চিকিত্সা বিজ্ঞানে আরো অগ্রগতি অর্জনে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিত্সা বিজ্ঞানের উন্নতিতে কী করা যায় তা নিয়ে ভাবছেন। প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গাপুরে তার সরকারি সফরকালে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় শেখ হাসিনা সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, ‘আপনাদের চিকিত্সা সেবা এত উন্নত হওয়ার কারণ কী। আমাদের দেশে যাদের চিকিত্সা সম্ভব হয় না, আপনাদের দেশে আসলে সে ভাল হয়ে যায়।’ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্ম নাসিমও চিকিত্সা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরই বলেন, চিকিত্সা সেবা নিয়ে রাজনীতি করা যাবে না। গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইত্তেফাককে বলেন, চিকিত্সকদের মানুষের সেবায় নিয়জিত থাকতে হবে। কেউ রাজনীতি করতে চাইলে প্রতিষ্ঠানে নয়, বাইরে গিয়ে রাজনীতি করতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বেসরকারি মেডিক্যাল শিক্ষার একটি নীতিমালা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সব কিছু নিয়ম নীতির মধ্যে নিয়ে আসা হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, রাজধানীর ৮টি সরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনা জানান, হাসপাতালগুলোতে চলছে চরম দলাদলি। এ দলাদলির কারণে চিকিত্সা সেবা মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে অনেকে চিকিত্সা শিক্ষা ভুলতে বসেছেন। এ অবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই, বাঁচতে চাই। তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চিকিত্সকদের দলীয় রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে।

এদিকে চিকিত্সা সেবার ক্ষেত্রে ভুল সারাবিশ্বেই হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশ ভুল চিকিত্সা থেকে অনেকটা উঠতে সক্ষম হচ্ছে। সম্প্রতি নেপালে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত কবির হোসেনকে দেশে চিকিত্সা সেবা দেওয়া হচ্ছিল। ইনফেকশনের কারণে তার এক পা কাটার পরামর্শ দিয়েছিল বাংলাদেশের চিকিত্সকরা। তবে পরিবার মানতে নারাজ। ডাকঢোল পিটিয়ে কবির হোসেনকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরের চিকিত্সকরা তার ডান পা হাঁটু পর্যন্ত কেটে ফেলেছে। সিঙ্গাপুরের চিকিত্সকরা অধ্যাপক ডা. সামান্ত লাল সেনের কাছে মোবাইলে এসএমএম পাঠিয়ে বলেন, আপনার পরামর্শ সঠিক ছিল। এমন অনেক উদাহরণ আছে। গ্যাস্ট্রো এন্ট্রোলজিক্যাল অধ্যাপক ডা. নজিবুর রহমান ভূঁইয়া সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে মারা যান। মেডিসিনের ক্ষেত্রে অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ, গ্যাস্ট্রো এন্ট্রোলজিক্যালে অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান, নাক, কান, কলার অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, নিউরোলজির অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ, অধ্যাপক ডা. সজল ব্যানাজি, কিডনির অধ্যাপক হারুনসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন চিকিত্সক বাংলাদেশে আছেন। তবে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির পাশাপাশি প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। দেশে অধিকাংশ বেসরকারি প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঠিক নেই। এক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালে হ-য-ব-র-লা অবস্থা বিরাজ করছে। বাণিজ্যিক দিকে প্রাধান্য দিয়ে সেবার মানে ছিটেফোটাও নেই। বেসরকারি প্যাথলজিক্যালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। এছাড়া বেঙের ছাতার মতো যেসব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে, তারা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। হয় এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে, নইলে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শুধু তাই নয়, মনিটরিং না থাকায় বেসরকারি অনেক দামিনামি হাসপাতালেও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও অব্যবস্থাপনা ধরা পড়ছে।

এদিকে ওষুধ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। বিদেশে যেসব ওষুধ রপ্তানি করা হয় তার একরকম মান থাকে, আর দেশের ওষুধের মান আরেক রকম। আবার ঢাকার ওষুধের থেকে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের ওষুধের মানে ব্যাপক তফাত্। এমনও হচ্ছে যে, চিকিত্সক ওষুধ দিয়েছে, সে ওষুধে কোন কাজ হচ্ছে না। তবে ওই চিকিত্সক একই ওষুধ অন্য কোম্পানির দিলে কাজ হচ্ছে। কিংবা বাইরের ওষুধ দিলে রোগী ভাল হয়ে যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিত্সা সেবার মান আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উন্নীত হলেও সেখানে আছে দলাদলি, গ্রুপিং। আর এসব কারণে সেখানে চিকিত্সা সেবা, শিক্ষা ও গবেষণার কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে চিকিত্সকদের মেধা ও মননের বিকাশ অনেকক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা নিয়োগ, বদলি, বাণিজ্য, দলাদলি আর গ্রুপিং নিয়েও ব্যস্ত থাকে। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে অধিদপ্তর, স্থানীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দলাদলির কারণে তিক্ত-বিরক্ত হচ্ছেন। সেখানে প্রশাসনিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এমন সত্যতা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ইত্তেফাককে জানিয়েছেন।

এদিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সারওয়ার আলম ১২৫টি হাসপাতালে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে মোট ৩৪ জনের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। ওই সব হাসপাতালে পেয়েছে ১২ জন ভুয়া ডাক্তার। এমনকি এসব ভুয়া ডাক্তার অপারেশনও করছিল।






মতামত দিন।

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*